ভারতে আরব ও তুর্কি আক্রমণ

  • সিন্ধু রাজ্য ছিলো পশ্চিম ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। সিন্ধুর রাজা সাইসি বা সাহসি পারসিক দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করলে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় সাহসি সিন্ধুর সিংহাসনে বসেন। এই সময় সিন্ধুর রাজধানী ছিল আলোর নগরী।
  • দ্বিতীয় সাহসির মৃত্যুর পর তাঁর ব্রাক্ষণ মন্ত্রী চাচ তাঁর সিংহাসনে বসলে সিন্ধু-তে ব্রাহ্মণ রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • চাচ এর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই চন্দর এক বিশাল এলাকার উত্তরাধিকারী হিসাবে সিংহাসনে বসেন। তিনি সাত বছর শাসন করেন।
  • এরপর চাচের ছোটো ছেলে দাহির আনুমানিক ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে আলোর সিংহাসনে বসেন। তাঁর সময় থেকেই সিন্ধু দেশে আরব আক্রমণ শুরু হয়।
  • সিন্ধুর সিংহাসনে বৈধ রাজবংশ কে সরিয়ে চাচ সিংহাসনে বসায় সামন্ত রাজারা চাচের ও দাহিরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ব্রাহ্মণ রাজারা নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার করত। এইসব কারণে দাহিরের জনপ্রিয়তা ছিলো না। এই সুযোগে আরবরা সিন্ধু আক্রমণ করে।

আরব অভিযান

  • হজরত মহম্মদ এর মৃত্যুর পর খলিফা ওমর-এর শাসনকালে ভারতে প্রথম আরব অভিযান আরম্ভ হয়। কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয়। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয় অভিযান-ও প্রেরিত হয় কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন কারণে ব্যার্থ হয়।
  • এর পর খলিফা অল ওয়ালিদের আমলে ইরাকের আরব শাসনকর্তা হজ্জাজ ৭০৮ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় সিন্ধু অভিযান আরম্ভ করেন। হজ্জাজ তাঁর জামাতা সেনাপতি মহম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অভিযান পাঠান।
  • হজ্জাজের নির্দেশে মহাম্মদ বিন কাশিম সরাসরি দাহিরের বিরুদ্ধে আক্রমণে উদ্যত হয়েছিলেন। ৭১২ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই জুন চূড়ান্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঘোরতর যুদ্ধরত পর দাহির নিহত হন।
  • দাহিরের পুত্র জয়সিংহ ও আরবদের প্রতিহত করার বহু চেষ্টা করেন। কিন্তু জয়সিংহ-এর মন্ত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতায় আলোরের পতন ঘটে।
  • মহম্মদ সিন্ধুর অধিকৃত অঞ্চলে আরব শাসন প্রবর্তন করেন । ইতিমধ্যে ৭১৪ খ্রিস্টাব্দে হজ্জাজের মৃত্যু হলে কাশিম স্বদেশে ফিরে যান।
  • মহম্মদের পর সিন্ধুর শাসনকর্তা ছিলেন জুনাইদ। তিনি দাহিরে র পুত্র জয়সিংহ-কে পরাজিত করে সমগ্র সিন্ধু অধিকার করেন। এরপর জুনাইদ অন্যান্য স্থানেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন কিন্তু দেশীয় রাজবংশ গুলির চেষ্টায় তাঁর আর স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
  • শেষ পর্যন্ত প্রতিহার আক্রমণের ফলে আরব রাজ্য বিধ্বস্ত হয় এবং সিন্ধু-তে আরব শক্তির পতন ঘটে।
  • আরবরা দীর্ঘ তিনশো বছর সিন্ধুদেশে রাজত্ব করেন।
  • আরবদের সিন্ধু অভিযানের প্রথম দিকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের কিছু ঘটনা ঘটলেও পরবর্তীতে আরব শাসক গণ ধর্মীয় উদারতা প্রদর্শন করেন।
  • সরকারী আয়ের প্রধান দুটি উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব “খারাজ ” ও ” জিজিয়া “।
  • কাজীরা কোরানের নির্দেশ মেনে বিচার করতেন। অপরাধে কঠোর দণ্ড দানের ব্যাবস্থা ছিলো।
  • আরব শাসকরা সিন্ধু দেশে যে শাসন নীতি প্ৰবর্তন করেছিলেন পরবর্তি কালে তুর্কি শাসক ও মুঘল শাসক দের নীতিতে তাঁর ছায়া পড়ে।

উত্তর ভারতে তুর্কি আক্রমণ

  • তুর্কি আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল না। বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েকটি স্থানীয় শক্তি দেশ শাসন করতো। বৈদেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জোট বাঁধার কোনো চেষ্টা তাদের মধ্যে ছিল না।
  • এগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বংশ ছিল.. কাশ্মীর এর কার্কট বংশ, হিন্দুকুশ থেকে পাঞ্জাবের চেনাব নদী পর্যন্ত শাহী বংশ, বাংলার পাল ও সেন বংশ, কনৌজের প্রতিহার বংশ, দিল্লি ও আজমীরের চৌহান বংশ। তাঁরা নিজেদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবার-ও চেষ্টা করে নি।
  • সমাজে জাতিভেদ প্রথাও তীব্র ছিল…. নারীরা ছিলো খুবই অবহেলিত।
  • এই সব কারণের জন্যই ভারতে নির্দ্বিধায় সতেরো বার অভিযান চালানোর সুযোগ পান সুলতান মামুদ। ভারতীয় নৃপৃতি বর্গ-এর হতবুদ্ধি ও পরস্পর ঈর্ষাপরায়ণতা ভারতে মুসলমান শাসকদের আগমনকে প্রলুব্ধ করেছিল।

মামুদের বংশ পরিচয়:

  • ইয়ামিনি বংশীয় আলপ্তিগীন আফগানিস্তানের গজনীতে যে রাজ্য স্থাপন করেন তা ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম এবং এই বংশ গজনভী বংশ বলে পরিচিত হয়।
  • আলপ্তিগীনের জামাতা সু বক্তিগীন নিজ বাহু বলে বৈদেশিক আক্রমণ ও বিদ্রোহ দমন করে গজনীর সিংহাসনে বসেন ৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে।
  • এই সময় ভারতের সীমান্তে হিন্দু শাহী বংশ রাজত্ব করতো। সুবক্তিগীন তাঁর রাজ্য দখল করার চেষ্টা করলে জয়পাল তাঁকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা নেন। এরফলে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। জয়পালের সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং জয়পাল একটি সন্ধির দ্বারা তাঁর রাজ্যের কিছু অংশ ও কয়েকটি রণহস্তি সুবক্তি গণকে ছেড়ে দিতে প্রতিশ্রুতি দেন।
  • নিজ রাজ্যে ফিরে এসে জয় পাল সন্ধির শর্তগুলি নাকচ করে দেন , এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুবক্তিগীন তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেন। জয় পাল জোট সহ গজনী অভিযান করেন কিন্তু তিনি শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন।
  • তিনি তাঁর রাজ্যের ভিতর দিয়ে খাইবার পর্যন্ত অঞ্চলের যোগাযোগ এর জন্য রাস্তা তৈরি করতে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে এই রাস্তা ধরেই সুলতান মামুদ ভারত আক্রমণ করেন।
  • ইতিমধ্যে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে সবুক্তিগীনের মৃত্যু হয়। সবুক্তিগীন তাঁর মধ্যম পুত্র ইসমাইল কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান কিন্তু তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মাহমুদ বা মামুদ তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা-কে বিতাড়িত করে গজনীর সিংহাসন ৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে দখল করেন।
  • সুবক্তিগীণের অনুসৃত রাজ্য বিস্তার নীতি তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুলতান মামুদ অনুসরণ করেন। তিনি ছিলেন সাহসী সেনাপতি এবং রণকৌশলে অসাধারণ দক্ষ।
  • সুলতান মামুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক ভারতের ধনরত্ন লুঠ করার লোভ বলে মনে করেন।
  • হেনরী এলিয়টের মতে সুলতান মামুদ সতেরো বার ভারত অভিযান করেন। তাঁর এই অভিযান গুলি ১০০০ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে।
  • ১০০১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ এক বিশাল সেনাদল সহ শাহী জয়পাল কে আক্রমণ করেন। জয়পাল প্রতিরোধ করেও হেরে যান। তিনি মামুদের কারাগারে বন্দী হন। প্রচুর ক্ষতিপূরণ ও তীব্র অপমান সহ্য করে তিনি মুক্তি পান। পরে নিজ রাজ্যে ফিরে এসে অপমানের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে তিনি আগুনে ঝাঁপ দেন।
  • তাঁর পুত্র আনন্দ পাল এরপর শাহী সিংহাসনে বসেন।
  • ১০০৯ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ আবার ভারত অভিযান করেন। মামুদের মুলতান অভিযানের সময় শাহী আনন্দ পাল তাঁর পথ অবরোধ করেন। এইজন্য সুলতান মামুদ তাঁকে শাস্তি দিতে প্রতিজ্ঞা নেন।
  • আনন্দ পাল অন্যান্য রাজপুত রাজা গুলোর সঙ্গে জোট বেঁধে মামুদকে বাধা দানের জন্য প্রস্তুতি নেন। কিন্তু উন্দের যুদ্ধে আনন্দপাল সুলতান মামুদের হাতে শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হলে ভারতের দরজা গজনী বাহিনীর কাছে খুলে যায়।
  • আনন্দ পালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ত্রিলোচনপাল পিতার সিংহাসনে বসেন। সুলতান মামুদের আক্রমণে ত্রিলোচনপাল কাশ্মীরে আশ্রয় নেন।
  • ত্রিলোচন পালের পর তাঁর পুত্র ভিমপাল সিংহাসনে বসেন, কিন্তু তিনিও সুলতান মামুদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেন নি। এইভাবে সুলতান মামুদের বারংবার আক্রমণে হিন্দু শাহী রাজবংশের চূড়ান্ত পতন ঘটে। এই বংশের পতন মামুদের কাছে ভারতের প্রবেশদ্বার খুলে দেয় ।
  • ১০২৪ – ২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদ গুজরাটের সোমনাথ মন্দির লুঠের জন্য একটি অভিযান পরিচালনা করেন। সোমনাথ মন্দির ছিলো গুজরাটের কাথিয়াবাড়ের সমুদ্র তীরে অবস্থিত। এই মন্দিরের শিব লিঙ্গ ছিলো হিন্দুদের কাছে খুবই জাগ্রত দেবতা। শত শত বছর ধরে সোমনাথের মন্দিরে বিরাট সম্পদ জমা হয়েছিল। বিগ্রহের উপর এক মহামূল্য হীরা ও রত্নখচিত চন্দ্রাতপ ছিলো। মন্দিরের অসংখ্য ভক্ত, দেবদাসী, পুরোহিত দের বাধায় সুলতান মামুদের প্রথম চেষ্টা বিফল হয়।
  • তিনি দ্বিতীয় বার আক্রমণে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করেন। মন্দির ও বিগ্রহটি ধ্বংস করা হয়। দুই কোটি দিনার, বহু অলংকার, হীরা ও রত্ন খচিত চন্দ্রাতপ , সোনা ও রূপার তৈরি মহামূল্য সম্পদ নিয়ে তিনি গজনী তে ফিরে যান।
  • এরপর তিনি মধ্য এশিয়ার রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকেন। ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।
  • এত কিছু সত্বেও সুলতান মামুদ বিবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন এবং তিনি বিদ্বানদেরও সমাদর করতেন। তাঁর দরবারে ছিলেন ঐতিহাসিক উৎবী, শাহনামা কাব্যের রচয়িতা বিখ্যাত ফিরদৌসী। তাঁর চেষ্টায় গজনী ইসলামিক সংস্কৃত চর্চার একটি বিখ্যাত কেন্দ্র হয়ে ওঠে। গজনীতে তিনি মুসলিম পাঠ কেন্দ্র, গ্রন্থাগার, জাদুঘর তৈরী করেন।
  • আলবেরুনী ছিলেন মধ্য এশিয়ার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত।তিনি দশ বছর মামুদের আদেশে ভারতবর্ষে কাটিয়েছিলেন। তাঁর “তহকিক-ই-হিন্দ” গ্রন্থ থেকে সেই সময়কার ইতিহাস জানা যায়।

মহম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণ

  • পশ্চিম আফগানিস্তানে গজনী ও হিরাট এর মাঝামাঝি স্থানে দশ হাজার ফুট উঁচুতে ঘুর অঞ্চল অবস্থিত ছিল। আলাউদ্দিন হুসেন কে ঘুর বংশের প্রথম সুলতান বলে মনে করা হয়। এরপর ঘুরের সিংহাসনে বসেন গিয়াসউদ্দিন মহম্মদ ঘুরী। তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন তাঁর ভাই সিহাবুদ্দিন বা মুইজুদ্দিন মহম্মদ ঘুরী।
  • সাম্রাজ্য স্থাপনের উদ্দেশ্যে মহম্মদ ঘুরী ভারত আক্রমণ করেন। ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ ঘুরী তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজিত হয়ে লাহোরে ফিরে যান।
  • ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে মহম্মদ ঘুরী পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত ও বন্দী করে গজনীতে এনে হত্যা করেন ।
  • ১১৯৩ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল মহম্মদ ঘুরীর পরিকল্পনায় ও তাঁর বিশ্বস্ত কুতুবুদ্দিন আইবকের সহযোগিতায় দিল্লি ও আজমীর কে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতে মুসলমান তথা তুর্কি শাসনের প্রতিষ্ঠা ঘটে।
  • উত্তর ভারতে তুর্কি শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও পূর্ব ভারতের বাংলা ও বিহার তখনও সেন রাজাদের অধিকারে ছিলো। তুর্কি জায়গীরদার বখতিয়ার খলজি ১২০২ থেকে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা ও বিহার জয় করেন। এরফলে তুর্কী শাসন বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। মহম্মদ ঘুরী ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে শেষ বারের মতন ভারতে আসেন। তিনি বিদ্রোহী খোক্কর উপজাতিকে দমন করার জন্য কাংড়া ও কাশ্মীর সীমান্তে অবস্থান করেন। এই সময় জনৈক গুপ্তঘাতকের দ্বারা তিনি নিহত হন ( ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে)।